বিএসএমএমইউতে বিশ্ব কিডনী দিবস ২০২৫ উদযাপিত
সকল পর্যায়ে সবার সচেতনাতেই মরণব্যাধি কিডনী রোগ প্রতিরোধ সম্ভব
বিএসএমএমইউর শিশু কিডনী বিভাগের উদ্যোগে ১ বছরের ৬ সহ¯্রাধিক শিশু কিডনী রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদান
র্যালি, সেমিনার, লিফলেট, স্যুভেনির বিতরণসহ জনসচেতনামূলক নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বিএসএমএমইউতে বিশ্ব কিডনী দিবস ২০২৫ উদযাপিত হয়েছে। দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫ইং তারিখে বিএসএমএমইউর ক্যাম্পাসে শিশু কিডনী বিভাগের উদ্যোগে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে র্যালির শুভ উদ্বোধন করেন মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম। এবারে বিশ্ব কিডনী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো “আপনার কিডনী কি সুস্থ? দ্রুত পরীক্ষা করুন, কিডনী স্বাস্থ্য সুরক্ষা করুন।” গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশনের উদ্যোগেও বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অডিটরিয়ামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এসকল কর্মসূচীতে বক্তারা সকল পর্যায়ে সবার সচেতনাতেই মরণব্যাধি কিডনী রোগ প্রতিরোধ সম্ভব বলে উল্লেখ করেন। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ যাদের রয়েছে তাদেরকে কিডনী বিষয়ে অধিকতর সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
বিএসএমএমইউর শিশু কিডনী (পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি) বিভাগ ও পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি সোসাইটি অফ বাংলাদেশ আয়োজিত র্যলিপূর্বক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম বলেন, শিশুদের যদি কিডনী রোগ থাকে, তা দ্রুত সনাক্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। শিশুদের ডায়ালাইসিস ইউনিটে জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। শিশু কিডনী বিভাগের উদ্যোগে ‘আরলি ডিটেকশন এন্ড প্রিভেনশন অফ রেনাল ডিজিজস ইন চিলড্রেন” শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেখানে শিশু নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি সোসাইটি অফ বাংলাদেশ এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম জানান, বিএসএমএমইউর শিশু কিডনী বিভাগের উদ্যোগে গত এক বছরের ৬ সহ¯্রাধিক শিশু কিডনী রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৪ শত ৯৩ জন, ভর্তি হয়ে চিকিৎসেবা নিয়েছে ৬৮৫ জন শিশু এবং ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হয়েছে ৩৮ জন শিশুকে। এখানে আয়োজিত সেমিনারে অধ্যাপক ডা. গোলাম মাঈন উদ্দিন, অধ্যাপক ডা. কবির আলম, অধ্যাপক ডা. শামীম পারভেজ, সহযোগী অধ্যাপক ডা. সালমা জাহান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সাইমুল হক, সহযোগী অধ্যাপক ডা. তাহমিনা জেসমিন, সহকারী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী অধ্যাপক ডা. মোছাঃ শানজিদা শারমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও বিএসএমএমইউর নেফ্রোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্যও পরিবার কর্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মাননীয় সচিব মোঃ সাইদুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএসএসএমইউর মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপকা ডা. মোঃ আবু জাফর, কিডনী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ, বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মোঃ আবুল কালাম আজাদ, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মোঃ মুজিবুর রহমান হাওলাদার, অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ। গুরুত্বপূর্ণ এই আলোচনা সভায় বিএসএমএমইউর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মোঃ নজরুল ইসলাম, নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এএইচ হামিদ আহমেদ, বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশনের যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. মেজবাহ উদ্দিন নোমান, সদস্য সচিব ডা. মোঃ ফরহাদ হাসান চৌধুরী প্রমুখসহ কিডনী বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, চিকিৎসক, রেসিডেন্ট, নার্স ও টেকনিশিয়ানবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মাননীয় সচিব মোঃ সাইদুর রহমান বলেন, কিডনী রোগে প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। স্কুল পর্যায়ের পাঠ্য বইতে কিডনী রোগ বিষয়ে সচেতনামূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিশেষ অতিথি বক্তব্যে মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম বলেন, কিডনী রোগ প্রতিরোধে শুধু রোগী নয়, চিকিৎসক এমন কি শিক্ষকদেরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। চিকিৎসকরা যাতে আনরেজিস্ট্রার্ড প্রডাক্ট প্রেসক্রিশনে না লিখেন সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ব্যথানাশক ওষুধ লেখার বিষয়েও অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সাথে কিডনী রোগে চিকিৎসায় এভিডেন্স বেইসড মেডিসিনকে গুরুত্ব দিতে হবে, গাইডলাইন ফলো করে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে।
বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মোঃ মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, কিডনী রোগ চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি গবেষণাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। চিকিৎসাসেবায় স্টেম সেল থেরাপি কিভাবে ব্যবহার করা যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ও ডিসিপ্লিনারি টু ডিসিপ্লিনারি ইন্টারেকশন কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।
বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মোঃ আবুল কালাম আজাদ তাঁর বক্তব্যে কিডনী রোগ প্রতিরোধে রুটিন পরীক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেন। একই সাথে রেজিস্ট্রার্ডকৃত চিকিৎসক এর মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
কিডনী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ তার বক্তব্যে কিডনী রোগ প্রতিরোধ, কিডনী ট্রান্সপ্ল্যান্ট, সিএপিডি চিকিৎসার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, কিছু ব্যথানাশক ওষুধ রয়েছে, যা রোগীদের কোনোভাবেই সেবন করা উচিত না। কারণ অনেক মানুষের জীবন এ ধরণের ওষুধ সেবন করে কিডনী বিকল হয়ে যাচ্ছে। তাই এই বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যে সকল ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়, তার উপর সরকার আরোপিত সকল প্রকার ভ্যাট ও ট্যাক্স সম্পূর্ণরূপে মওকুফ করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ ওই সেমিনারে জানানো হয়, বাংলাদেশে কিডনী রোগে আক্রান্তের মানুষের সংখ্যা ২২.৪৮ শতাংশ। এরমধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ মহিলা এবং ২০ শতাংশ পুরুষ। সে হিসাবে ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে কিডনী রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি এবং দ্রুত হারে এ সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী গত এক দশকে কিডনী রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই মহামারিতে বছরে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কিডনী বিকল্প হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে সক্ষমত রয়েছে সে অনুযায়ী মাত্র ২০ শতাংশ রোগীকে ট্রান্সপ্ল্যান্ট, ডায়ালাইসিস ও অন্যন্য চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তার মানে ৮০ শতাংশ রোগী বিনা চিকিৎসায় ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করছে। বাংলাদেশেসহ বিশ্বব্যাপী কিডনী রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীতে বর্তমানে ৮৫ কোটি মানুষ কিডনী রোগে ভুগছে। মাত্র ২ যুগ আগেও মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনী রোগ ছিল ২৭তম স্থানে, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ম স্থানে এবং ২০৪০ সালে তা আরো বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৫ম স্থানে।
সম্পাদনা: সাইফুল আজম রঞ্জু। ছবি: মো: আরিফ খান। নিউজ: প্রশান্ত মজুমদার।